Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

পরবর্তী দশকের যুদ্ধ কি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ? - 1

# পরবর্তী দশকের যুদ্ধ কি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ?  


# যুদ্ধের বিবর্তন:


প্রাচীনকালে যুদ্ধ ছিল মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বিতার অঙ্গ। তখন লড়াই হত সরাসরি— লাঠি, পাথর, তলোয়ার; তীর-ধনুক থেকে হাতে হাতে সংঘাত, কখনো কখনো হাতির পিঠে উঠে শত্রুকে পদপিষ্ট করা— সবই ছিল যেন জীবনের অবিচ্ছিন্ন পালা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্র বদলালো, কামান, বন্দুক, ট্যাংক, যুদ্ধবিমান— এগুলো চলে এলো। আর ২০শ শতকে এসে দেখা গেল এমন এক ভয়ঙ্কর ধ্বংসযন্ত্র— পারমাণবিক বোমা— যা এক মুহূর্তে শহরকে ছাই করে দিতে পারে। হিরোশিমা-নাগাসাকি আমাদের স্মৃতিতে সেই ভয়াবহ অধ্যায় রেখেই গিয়েছে।  

কিন্তু যুদ্ধ থেমে থাকেনি। পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহতা বৈশ্বিক জিও পলিটিক্সের ভারসাম্য গড়ে দিলেও সেই সঙ্গে উঠে এলো এক অন্য ধরনের সংগ্রাম— ঠান্ডা যুদ্ধ। এতে সরাসরি বন্দুক চালাল না কেউ, বরং তথ্য, প্রোপাগান্ডা, আর প্রযুক্তিকৌশলকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে তারা লড়াইয়ে নামল। স্পেস রেস, গুপ্তচরবৃত্তি, অর্থনীতি ও সামরিক প্রভাব প্রতিপত্তি এই— সবকিছুই ছিল একটা নতুন ধাঁচের যুদ্ধক্ষেত্র।  

এখন আমরা এমন একটা সময়ে পৌঁছে গেছি যেখানে যুদ্ধ আর কেবল ভৌত জমির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। যুদ্ধক্ষেত্র এখন সরে এসেছে অদেখা এক জায়গায়— সার্ভার, ক্লাউড, নেটওয়ার্ক, অ্যালগরিদম ও ব্যবহারকারীর ডেটার ভেতরে।
এই যুদ্ধের গোলা হচ্ছে— ডেটা; সৈন্য হচ্ছে—ব্যবহারকারী; কমান্ডার— অ্যালগরিদম। তাই এখন যুদ্ধটা হচ্ছে অ্যালগরিদম বনাম অ্যালগরিদমের মধ্যে। একটি মডেল চেষ্টা করবে অন্য মডেলের সিদ্ধান্তকে বিভ্রান্ত করতে, একটি সার্ভার চেষ্টা করবে অন্য নেটওয়ার্ককে ডাউন করতে, একটি প্ল্যাটফর্ম চেষ্টা করবে মানুষের মন ও বাজার নিজের দিকে টেনে আনতে।



# প্ল্যাটফর্ম কেবল সার্ভিস নয়— এগুলো ক্ষমতার উৎস:

আজকের সোশ্যাল মিডিয়া, মেসেজিং অ্যাপ, সার্চ ইঞ্জিন বা পেমেন্ট নেটওয়ার্ক শুধুই সুবিধা দেয় না— শক্তিও তৈরি করে। এগুলোর কাছে থাকে মানুষের খাদ্যাভ্যাস, কেনাকাটার ধরণ, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, এবং সামাজিক সংযোগের মানচিত্র। একটি প্ল্যাটফর্ম যখন বড় সংখ্যায় ব্যবহারকারী পেয়ে যায়, তখন সেটি কেবল ব্যবসা করে না— নির্ধারণ করে কী দেখবে, কে কী শুনবে, কে কী বিশ্বাস করবে। এমনকি কে কী ধরনের ভাবনা চিন্তা করবে, এই বিষয়টিও এখন এরাই ঠিক করে দেয়।

একটি প্রভাবশালী প্ল্যাটফর্ম সঠিক সময়ে সঠিক কনটেন্ট বিস্তার করলে তা দ্রুত জনসমক্ষে ধারণা গড়ে দিতে পারে— এই ধারণা রাজনৈতিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপকি পরিবর্তন এনে দিতে সক্ষম। প্ল্যাটফর্মগুলো এখন ন্যারেটিভ-নিয়ন্ত্রণের মতো কাজ করে; যারা ন্যারেটিভ ধরবে, তারাই আন্তর্জাতিক মঞ্চে কণ্ঠশক্তি পাবে।  



# রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট: দক্ষিণ এশিয়ার তিন উদাহরণ:

ডিজিটাল প্রভাব কেবল তত্ত্ব নয়— দক্ষিণ এশিয়ার ভূ রাজনীতির বাস্তবেও আমরা দেখেছি এর প্রভাব কেমন তীব্র। শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপাল— এই তিন দেশই স্মরণ করিয়ে দেয় কীভাবে অনলাইন চ্যানেল রাজনৈতিক ধাক্কা বাড়িয়ে দেয় বা পরিস্থিতিকে উসকে দেয়।

শ্রীলঙ্কা: অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়া দ্রুত তথ্য ছড়ায়; মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত বার্তা ভাইরাল হয়ে জনবিক্ষোভকে বিস্ফোরিত করে দেয় এবং শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে বড় ধরনের পরিবর্তন ডেকে আনে। অনলাইন ডিসইনফরমেশন পরিস্থিতিকে ত্বরান্বিত করে দেয়।  

বাংলাদেশ: ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের মাধ্যমে অনলাইন কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ বিতর্ক বিরাট আকার ধারণ করেছে। অনলাইন সমালোচনা ও আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা রাজনীতি ও সামাজিক উপাদানকে নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে।  
নেপাল: এই ছোট্ট দেশে সোশ্যাল মিডিয়ার এক মেসেজই দ্রুত জনমত পরিবর্তন করে— এখানে অনলাইন প্রচারণা রাস্তায় আন্দোলনে রূপ নিলে তা রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটিয়ে দিতে সক্ষম হয়।

এই তিনটি দেশের অভিজ্ঞতাই বলে— রাজনীতিতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম কেবল সংযোগ মাধ্যম নয়; তারা ন্যারেটিভ-বিল্ডার, মনোভাব রূপান্তরক ও অনলাইন অপারেটিং সিস্টেম— যেই মুহূর্তে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়, তারা যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি করে দিতে পারে।  



# হ্যাকিং, সাইবার ক্রাইম ও আর্থিক ক্ষতি:


ডিজিটাল যুদ্ধের সবচেয়ে সরাসরি অস্ত্র হলো হ্যাকিং। আর্থিক সিস্টেমে হানা, ব্যাংকিং নেটওয়ার্কে ভাঙন, কাস্টমার ডেটা চুরি— এসব আজ আর গল্প নয়। প্রতিনিয়ত হাজার হাজার কোটি টাকা প্রতারণা, র্যানসমওয়্যার আক্রমণ, অনলাইন চুরির ঘটনা হচ্ছে। একটি সফল সাইবার আক্রমণ হাসপাতালের সিস্টেমকে ডিজেবল করে দিতে পারে; ব্যাংকের পেমেন্ট গেটওয়েটে দুর্বলতা পেয়ে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হাইজ্যাক করে দেওয়াও অসম্ভব নয়।  

কীভাবে ঘটে আর্থিক লোপাট/ক্ষতি ?

- ফিশিং ও সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে ভুয়া লেনদেন;  

- ম্যালওয়্যার বা র্যানসমওয়্যার দিয়ে সরকারি/বেসরকারি সিস্টেম সমগ্রভাবে অচল করে দেওয়া;  

- পেমেন্ট গেটওয়েতে দুর্বলতা অন্বেষণ করে সরাসরি ট্রানজেকশন হাইজ্যাক করা;  

- গ্রাহক-ডেটাবেস চুরি করে বিশাল স্কেলিং এ ভুয়া আর্থিক কার্যক্রম পরিচালনা।  

এই ক্ষতি শুধু সংখ্যায় সীমাবদ্ধ নয়—মানুষের স্বাস্থ্য, দৈনন্দিন জীবনের নিরাপত্তা, ও রাষ্ট্রীয় বিশ্বাসের মধ্যেও ব্রেক নিয়ে আসে। তাই সাইবার সিকিউরিটি আর পলিসি জাতীয় সম্পদ রক্ষায় অপরিহার্য।  



# সামরিক কৌশল: এআই, অটোমেশন ও অ্যালগরিদমিক যুদ্ধ

এখানে কথা শুধু ফেসবুক পোস্ট বা ব্যাংকিং ইস্যুতে সীমাবদ্ধ নেই— সামরিক ক্ষেত্রেও এখন প্রযুক্তি কার্ভযকর হচ্ছে। ভবিষ্যতে রাষ্ট্রগুলো স্বয়ংক্রিয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, এআই-চালিত ড্রোন-সোয়ার্ম, রোবোটিক প্ল্যাটফর্ম, স্যাটেলাইট-জ্যামিং ও সাইবার-অপারেশনকে কেন্দ্র করে কৌশল প্রস্তুত করবে। সিদ্ধান্তগুলো রিয়েল-টাইম ডেটা বিশ্লেষণ করে নেওয়া হবে; কখন আঘাত করা হবে, কোন নেটওয়ার্ককে নিশানা করা হবে— এসব সিদ্ধান্তে AI বড় ভূমিকা নেবে।  

কিন্তু এখানে বড় সমস্যা হল— ব্ল্যাক-বক্স AI। যখন সিস্টেম নিজেই সিদ্ধান্ত নেয়, তার ন্যায়-সংগততা, ত্রুটি নির্ণয় ও জবাবদিহিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ভুল সিদ্ধান্ত ছোট বা বড় উভয় ক্ষেত্রেই ভয়াবহ ফল দিতে পারে— নাগরিকদের ওপর আঘাতও আসারও সম্ভবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তাই AI ব্যবহারে নৈতিকতা, অডিটিং ও নিয়ন্ত্রক কাঠামো জরুরি হয়ে দাঁড়ায়।  



# ভারতের ঈর্ষণীয় উত্থান:

এটা অত্যন্ত খুশির খবর যে— ভারত ডিজিটাল ক্ষেত্রে দ্রুত মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। আমাদের দেশের ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিশাল; রিয়েল-টাইম পেমেন্টে আমরা বিশ্বে অগ্রভাগে; এবং স্থানীয় ভাষায় কনটেন্টে আমাদের শক্তি অনন্য। এই ব্যবহারকারী-ভরই আমাদের ‘ডিজিটাল সেনাবাহিনী’।  

কিন্তু সেনাবাহিনী মানেই দায়িত্বও— শক্তি রাখার সাথে সাথে রক্ষা করার কৌশলও জানা থাকা দরকার। এখন থেকেই নিজেদের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে, ডাটা-সেন্টার বাড়াতে হবে, নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে, এবং নাগরিকদের ডিজিটাল সচেতনতা বাড়াতে হবে— তাহলেই আগামী দশকে আমরা কেবল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারী না থেকে প্ল্যাটফর্ম-নির্মাতা ও রক্ষাকারী দেশ হিসেবে পরিণত হতে পারব।  



এই যুদ্ধ কেবল সেনাবাহিনীর নয়— এই যুদ্ধে প্রতিটি নাগরিককেই অংশ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের দায়িত্ব কী ?

- ডিজিটাল সুরক্ষার বেসিক মেনে চলা (দ্বি-স্তরীয় প্রমাণীকরণ, শক্ত পাসওয়ার্ড),  

- অনলাইন কনটেন্টে সাবধানতা, ফিশিং-চেক করা,  

- স্থানীয় প্ল্যাটফর্মকে সমর্থন করা (ভোকাল ফর লোকাল),  

- ডিজিটাল আইন ও নীতিতে রাজনৈতিক সচেতনতা বজায় রাখা।  

মনে রাখতে হবে— আমরাও যুদ্ধ করছি; তবে আমাদের যুদ্ধটা ধ্বংস করার জন্য নয়। এটি লড়াই শিখে নেওয়ার, তৈরি করার, রক্ষা করার এবং নীতিগত নিয়ম-কানুন দাঁড় করানোর যুদ্ধ— যাতে ভবিষ্যতটি আমাদের জন্য নিরাপদ, স্বাধীন এবং গৌরবময় হয়।